সাইবার হামলার সতর্কতায় ‘সীমিত’ ইন্টারনেট ব্যাংকিং

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ যেভাবে চুরি করা হয়েছিল, একইভাবে ব্যাংকগুলোতে সাইবার হামলার আশঙ্কায় বাড়তি সতর্কতা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সতর্কতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকগুলো। বেশকিছু ব্যাংক রাতে তাদের এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) সেবা বন্ধ রেখেছে। অনেকে আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহার সীমিত করেছে।

ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও পস লেনদেনও সীমিত করেছে অনেক ব্যাংক। কেউ কেউ আবার নিজস্ব কার্ড ছাড়া অন্য ব্যাংকের কার্ডের ব্যবহার সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ গ্রাহকরা।

উত্তর কোরিয়ার একটি হ্যাকার গ্রুপ ব্যাংকগুলোতে সাইবার হামলা চালাতে পারে— যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার এমন সতর্কতা জারির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোতে সাইবার নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দেয়া হয়। ওই নির্দেশনার পর অনেক ব্যাংক তাদের অনলাইন ব্যাংকিং সেবা সীমিত করেছে।

কোনো কোনো ব্যাংক তাদের এটিএম বুথ থেকে অন্য ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন বন্ধ করে দিয়েছে। সীমিত করা হয়েছে অনলাইন লেনদেনও। এটিএম বুথগুলোতেও বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের নিজস্ব কর্মীদের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবমিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।

জানা গেছে, গত ২৭ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা নির্দেশনার পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী, বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা, ইউসিবি, দি সিটি ব্যাংক, এনসিসি, আল-আরাফাহ্ ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক এটিএম বুথের সেবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ ও সীমিত করেছে। রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত এসব ব্যাংকের এটিএম সেবা বন্ধ থাকবে বলে গ্রাহকদের ইতোমধ্যে নোটিশ করা হয়েছে।

সাইবার হামলার সতর্কতার অংশ হিসেবে রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য এটিএম বুথ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)।  গত সোমবার ব্যাংকের পক্ষ থেকে এক ক্ষুদে বার্তায় গ্রাহকদের এমন তথ্য জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউসিবি’র কার্ড ডিভিশনের প্রধান নেহাল এ হুদা জাগো নিউজকে বলেন, উত্তর কোরিয়ার একটি হ্যাকার গ্রুপ বাংলাদেশে সাইবার হামলা চালাতে পারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সতর্কতা নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে রাতে এটিএম সেবা কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এটি আবার চালু হবে।

দি সিটি ব্যাংকও গত সোমবার নোটিশ দিয়ে জানিয়েছে যে, রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত তাদের এটিএম বুথ বন্ধ থাকবে। এর আগে দেশের সবচেয়ে বড় দুটি এটিএম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ডাচ্-বাংলা ও ব্র্যাক ব্যাংকও রাতের সেবা বন্ধ রাখার নোটিশ দেয়। এর মধ্যে ডাচ্-বাংলা রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা এবং ব্র্যাক ব্যাংক রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত এটিএম বুথ বন্ধ রাখার কথা জানায়।

মার্কেন্টাইল ও ট্রাস্ট ব্যাংকও রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত এটিএম সেবা বন্ধ রেখেছে। যমুনা ব্যাংক বন্ধ রাখছে রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত।

রাতে এটিএম সেবা বন্ধ রাখার বিষয়ে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাসরুর আরেফিন বলেন, সাইবার হামলার আশঙ্কায় এটিএম বুথের পাশাপাশি তাদের পস ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বন্ধ রাখা হচ্ছে। আপাতত সিটি ব্যাংকের এটিএম বুথ ব্যবহার করে অন্য ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসা গ্রাহকদের বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সবকিছু আগের মতো খুলে দেয়া হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পরই আমরা সব শাখাকে সাইবার হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছি। পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই লেনদেন করতে বলেছি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়তি এমন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, সম্প্রতি সাইবার হামলার বিষয়ে সরকারের কম্পিউটার ইনসিডেন্ড রেসপন্স টিম (সার্ট) ও পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে তথ্য আসে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর পর তারা সব ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দেয়।

‘কিন্তু বিষয় হলো, বাংলাদেশের পক্ষে ম্যালওয়্যার অ্যানালাইসিস করার সক্ষমতা বা তেমন কোনো ল্যাবরেটরি নেই। সতর্কতা হিসেবে যে ম্যালওয়্যারের কথা বলা হয়েছে, সেটি আসলে পুরনো। এর চেয়ে অনেক আধুনিক ম্যালওয়্যার আমাদের সিস্টেমে আসছে। এ বিষয়ে সরকারকে এখনই চিন্তাভাবনা করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাইবার বিষয়ক সতর্কতা নির্দেশনার পর কিছু ব্যাংক রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত এটিএম সেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আন্তর্জাতিক হ্যাকার বলতে কিছু নেই। আর হ্যাকাররা দিনে ঘুমাবে রাতে হ্যাকিং করবে, এটাও অবাস্তব। যারা হ্যাকিং করে তারা রাতে যেমন করতে পারে, দিনেও পারে। নির্দিষ্ট সময় বন্ধ না রেখে সিকিউরিটি অপারেশন সেন্টার করার পরামর্শ দেন এই সাইবার বিশেষজ্ঞ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাইবার হামলার আশঙ্কায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে কিছু ব্যাংক এটিএম সেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রেখেছে, এটা কাম্য নয়।

সূত্র জানায়, ম্যালওয়্যার ভাইরাসটি দেশের যে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) কোম্পানির সার্ভারে হামলা করেছে সেটি মেরামতের কাজ চলছে। একই সঙ্গে আরও যে দুটি ইন্টারনেট প্রটোকলে (আইপি) ম্যালওয়্যারের অস্তিত্ব মিলেছে সেগুলোকেও ব্লক করার চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) সাইবার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সার্ট) কাজ করছে। সার্টের সাইবার বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, অচিরেই ম্যালওয়্যার ভাইরাসগুলো ক্লিন করা সম্ভব হবে।

এসএমজে/২৪/রা

 

Tagged