এসএমজে ডেস্ক
পুঁজিবাজার বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন সিএমজেএফ টকে বক্তব্য রাখেন ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম। আজ শনিবার সকালে রাজধানীর পল্টনে সংগঠনটির কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো
বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সরকারের শীর্ষ পর্যায় ও বিভিন্ন সংস্থার চাপের কারণে অতীতে শেয়ারবাজারে সূচক ঠিক রাখা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমের প্রধান মাপকাঠি বা কেপিআইয়ে পরিণত হয়েছিল। এ কারণে সূচকের পতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তর আরোপের মতো ঘটনাও ঘটেছে। ফ্লোর প্রাইস শেয়ারবাজারের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে দেশের বড় বড় বিনিয়োগকারীও এখনো ফ্লোর প্রাইস আতঙ্কে ভুগছেন। তাই শেয়ারবাজারে কঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।
শেয়ারবাজারের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম বা সিএমজেএফ টকে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম। আজ শনিবার সকালে রাজধানীর পল্টনে সিএমজেএফ কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সভাপতি গোলাম সামদানি ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবু আলী।
সাংবাদিকদের প্রশ্ন ও অতিথির বক্তব্যভিত্তিক এ অনুষ্ঠানে ডিএসই চেয়ারম্যান বলেন, দেশের অর্থনীতিতে প্রকৃত বিনিয়োগ না হলে শেয়ারবাজারেও বিনিয়োগ বাড়বে না। ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও ট্রেজারি বিল-বন্ডের উচ্চ সুদ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে বর্তমানে বিনিয়োগে কিছুটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রকৃত বিনিয়োগে যতটা খরা , তার চেয়ে বেশি খরা শেয়ারবাজারে। কারণ, অতীতের নানা অনিয়ম, অসংগতি ও আর্থিক ক্ষতির কারণে শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীরা সেভাবে আস্থাশীল হতে পারছেন না। তাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে একগুচ্ছ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ডিএসই। এসব কার্যক্রমের বাস্তবায়নও শুরু হয়ে গেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাবে। তাই আশা করছি, জুনের মধ্যে শেয়ারবাজারে কিছুটা গতি ফিরে আসবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মমিনুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে ডিএসইর বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ চারটি কাজে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এগুলো হলো সরকারের দিক থেকে শেয়ারবাজারের জন্য আলাদা কর প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, দেশি-বিদেশি কিছু ভালো কোম্পানিকে যত দ্রুত সম্ভব বাজারে আনা, ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণাত্মক ঋণহিসাব বা নেগেটিভ ইকুইটি সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা এবং শেয়ারবাজারে সুবিধাভোগী (ইনসাইডার) লেনদেন ও কারসাজি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ডিএসইর চেয়ারম্যান বলেন, যেকোনো সংস্কার কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাজারে আইনকানুনসহ অনেক কিছুরই সংস্কার করতে হবে। সংস্কারকে বেশি প্রাধাণ্য দিতে গিয়ে বিনিয়োগকারীরা যাতে বাজারবিমুখ হয়ে না পড়েন, সেটিকেও মাথায় নিতে আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু সংস্কারের কাজ করছি। আমরা কৃত্রিমভাবে বা শর্টকাট পদ্ধতিতে কাজ করে বাজারকে টেনে তুলতে চাই না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও পেশাদারি নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জের ভিত্তি মজবুত করা। শেয়ারবাজারে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেটি তারা রাখতে পারেনি। বরং স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা গত ১৫ বছরে অনেক বেশি সংকুচিত হয়ে গেছে। এ কারণে অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের ভূমিকা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
কারসাজি ও সুবিধাভোগী লেনদেন—এই দুটি বিষয়কে শেয়ারবাজারের অন্যতম সমস্যা বলে আখ্যায়িত করেন ডিএসই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, অতীতে প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কারসাজির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ স্টক এক্সচেঞ্জের ছিল না। স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা ছিল অনেকটা পোস্ট অফিসের মতো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকাকে বাজার উন্নয়নের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চাই। এ জন্য কিছু আইনি সংস্কারেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পরিদর্শন বা তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন লাগে। সেটি যাতে না লাগে, সে জন্য আমরা আইনি ক্ষমতা বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে তালিকাচ্যুত বা ডিলিস্টিং নীতিমালায়ও অনেক গলদ রয়েছে। সেখানেও পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোনো কোম্পানি যৌক্তিক কারণ ছাড়া অনিয়ম ও নিজেদের ভুলে খারাপ হয়ে গেলে সেসব কোম্পানির ক্ষেত্রে আমরা কঠোর হতে চাই। এ ধরনের কোম্পানি যাতে সরকারি কোনো সুবিধা না পায়, নতুন করে ব্যবসার সুযোগ, ব্যাংকঋণ নিতে না পারে—এ ধরনের বিধান রেখে ডিলিস্টিং নীতিমালা সংশোধনের কাজ চলছে বলে সাংবাদিকদের জানান ডিএসই চেয়ারম্যান।
কোনো ধরনের চাপ তৈরি করে শেয়ারবাজারে নতুন ও ভালো কোম্পানি আনার বদলে আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী করতে কাজ করছে ডিএসই। এ জন্য সরকারের কাছে করসুবিধা চাওয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামী বাজেটে এর কিছু প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের মান বৃদ্ধি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যে আর্থিক প্রতিবেদন দেয়, সেগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসের বড় ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে আমরা দেখেছি, শেয়ারবাজারে আসার আগে কোম্পানিগুলোকে অনেক বেশি লাভজনক দেখানো হয়। কিন্তু তালিকাভুক্তির কয়েক বছর না যেতেই এসব কোম্পানি রুগ্ণ কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
ব্রোকারেজ হাউসগুলোর দিক থেকে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা রোধে সমন্বিত বা ইন্টিগ্রেটেড ব্যাকঅফিস সফটওয়্যার চালুর বিষয়টিও ডিএসইর বিবেচনায় রয়েছে বলে জানান মমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে বিনিয়োগকারী সহায়তা তহবিলের আকার বাড়ানো হবে।
মমিনুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে ভালো কিছু কোম্পানি আনা সম্ভব হলে তাতে বাজারে একধরনের মোমেন্টাম বা গতি সঞ্চার হবে। সে জন্য ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে আমরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে কাজ করছি। স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাজারের কারসাজি রোধে আমাদের অবস্থান শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্স। এ ধরনের ঘটনায় ডিএসইর কেউ জড়িত থাকলে তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।