এসএমজে ডেস্ক
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি দাবিহীন ও অবণ্টিত বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের অর্থ ও শেয়ার আগামী ৩০ জুনের মধ্যে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে (সিএমএসএফ) জমা দেবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৬০টি কোম্পানির কাছে বিনিয়োগকারীদের নগদ ও বোনাস শেয়ার বাবদ পড়ে আছে ৭ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকা বিনিয়োগকারীদের এ টাকার মুনাফা কোম্পানিগুলো ভক্ষণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সেই সুযোগের অবসান হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এই কোম্পানিগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে যাচ্ছে। তাদের সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দিয়েছে বিএসইসি। অর্থাৎ আগামী ৩০ জুনের মধ্যে সিএমএসএফ ফান্ডে দাবিহীন ও অবণ্টিত অর্থ জমা দিতে হবে। এরপরও কোম্পানিগুলো যদি বিনিয়োগকারীদের এই অর্থ জমা না দেয় তবে জরিমানা গুণতে হবে।
কমিশনের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা সম্প্রতি বিএসইসি কোম্পানিগুলোকে দিয়েছে। চিঠির অনুলিপি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সিএমএসএফ ফান্ডকে পাঠানো হয়েছে।
সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নগদ লভ্যাংশ অথবা বোনাস শেয়ার সিএমএসএফে জমা দিতে ব্যর্থ হলে অনাদায়ী লভ্যাংশের উপর প্রতি মাসে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হবে। অর্থাৎ কোনো কোম্পানি যদি বিনিয়োগকারীদের নগদ ১০০ টাকা কিংবা ১০০ টাকার শেয়ার ফান্ডে জমা না দেয় তবে তাকে এই টাকার উপরে ২ টাকা ৫০ পয়সা করে প্রতি মাসে জরিমানা দিতে হবে।
এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়ত-উল-ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত বা অবিতরণকৃত লভ্যাংশের টাকা সিএমএসএফ ফান্ডে জমা দেওয়ার জন্য বলেছি। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানি ফান্ডে অর্থ জমা দিচ্ছে না। এ বিষয়ে কোম্পানিগুলোকে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন আর ছাড় দেওয়া যাবে না। যারা নির্ধারিত সময়ে বিনিয়োগকারীদের টাকা সিএএসএফ ফান্ডে জমা দেবে না তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
সূত্র জানায়, ২০২১ সালে সিএমএসএফ গঠন করার পর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে তিন বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকা দাবিহীন কিংবা অবিতরণকৃত লভ্যাংশ ফান্ডে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় বিএসইসি। এই নির্দেশের পর গত তিন বছরের কিছু কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নগদ ও বোনাস লভ্যাংশ জমা দিলেও অধিকাংশ কোম্পানি সেই অর্থ জমা দেয়নি। খাতওয়ারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাবিহীন অর্থ ও শেয়ার জমা না দেওয়ার শীর্ষে রয়েছে ব্যাংক খাত।
বিএসইসি কর্মকর্তারা বলেন, বিনিয়োগকারীদের অর্থ জমা দেওয়ার জন্য গত তিন বছর ধরে দফায় দফায় সময় দেওয়া হয়েছে কিন্তু কোম্পানিগুলো কালক্ষেপণ করছে। আর এই অর্থ দিয়ে নিজেরা ব্যবসা করছে। আবার কেউ কেউ ভেবেছিল এ টাকার হকদার কোম্পানিগুলোই, তাই তারা দিচ্ছে না।
বিএসইসির তথ্য মতে, বিনিয়োগকারীদের দাবিহীন লভ্যাংশের পরিমাণ ৮ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৫৪ কোম্পানির কাছে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ৫৯৯ কোটি আর ৩৪৯ কোম্পানির কাছে বোনাস শেয়ারের লভ্যাংশের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। সব মিলে ৪৬০টি কোম্পানির কাছে পাওনা ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫০টি কোম্পানি এখন পর্যন্ত নগদ ও বোনাস কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। আর ৩১০টি প্রতিষ্ঠানের আংশিক কিংবা অর্ধেক বাকি রয়েছে।
বিএসইসি সূত্রটি আরও জানায়, চলতি বছরের ৩০ মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিগুলো ফান্ডে মোট ১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। এর মধ্যে নগদ লভ্যাংশের টাকা জমা দিয়েছে ৫২০ কোটি আর বোনাস শেয়ারের অর্থ জমা দিয়েছে ৬৯৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ নগদ ৭৯ কোটি আর বোনাস শেয়ারের ৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকার এখনো জমা দেয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত বা অবিতরণকৃত লভ্যাংশের টাকা সিএমএসএফ ফান্ডে জমা দেওয়ার জন্য বলেছি। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানি ফান্ডে অর্থ জমা দিচ্ছে না। এ বিষয়ে কোম্পানিগুলোকে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন আর ছাড় দেওয়া যাবে না। যারা নির্ধারিত সময়ে বিনিয়োগকারীদের টাকা সিএএসএফ ফান্ডে জমা দেবে না তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোনাস ও নগদ টাকার পরিমাণ আরও বেশি হবে। ইতিমধ্যে কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত অর্থ হিসেবে ঠিক আছে কি না বা তারা সঠিকভাবে টাকা দিয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে ৫০টি কোম্পানিতে ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে অডিটর নিয়োগ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
সূত্র জানায়, ফান্ডটি চালুর সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রত্যাশা ছিল আকার হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। বিএসইসি কোম্পানিগুলোর কাছে লভ্যাংশ না দেওয়ার তালিকা চাওয়ার পর থেকে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ বিতরণ শুরু করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। ফলে ২১ হাজার কোটি টাকার ফান্ড কমে চলে আসে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। তাও এখনো সেই টাকাও জমা দিতে গড়িমসি করছে কোম্পানিগুলো।
সূত্র জানায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো কাছে এখন সবচেয়ে বেশি টাকা অনাদায়ী রয়েছে। ব্যাংকগুলো বিএসইসির সিএমএসএফ গঠনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এ বিষয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রশ্ন তোলার পর ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ দিতে অনীহা প্রকাশ করে। তবে বিষয়টি এরই মধ্যে সুরাহা হয়েছে বলে দাবি বিএসইসির। এখন কিছু ব্যাংক নগদ ও বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে ফান্ডে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংকই জমা দেয়নি।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সিএমএসএফ আয়োজিত এক
অবণ্টিত ও দাবিহীন লভ্যাংশ কী?
কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ ঘোষণার পর তা তাদের ডিভিডেন্ড অ্যাকাউন্ট থেকে বিনিয়োগকারীদের নামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নগদ লভ্যাংশ সরাসরি বিনিয়োগকারীদের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। স্টক লভ্যাংশ জমা হয় তাদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্টে।
২০২১ সালে সিএমএসএফ গঠন করার পর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে তিন বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকা দাবিহীন কিংবা অবিতরণকৃত লভ্যাংশ ফান্ডে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় বিএসইসি। এই নির্দেশের পর গত তিন বছরের কিছু কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নগদ ও বোনাস লভ্যাংশ জমা দিলেও অধিকাংশ কোম্পানি সেই অর্থ জমা দেয়নি। খাতওয়ারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাবিহীন অর্থ ও শেয়ার জমা না দেওয়ার শীর্ষে রয়েছে ব্যাংক খাত।
যাদের নামে শেয়ার তারা কেউ মারা গেলে, বিদেশে চলে গেলে, কিংবা দীর্ঘদিন খোঁজ না রাখলে তাদের ব্যাংক হিসাব বন্ধ বা অকার্যকর হয়ে যায়। বিও হিসাবের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এমন ক্ষেত্রে লভ্যাংশের টাকা বা শেয়ার বিনিয়োগকারীর ব্যাংক বা বিও অ্যাকাউন্টে জমা না হয়ে কোম্পানির কাছে ফেরত যায়।
বিনিয়োগকারীর মৃত্যুর পর অনেক সময় তথ্য বা কাগজপত্রের অভাবে তার মনোনীত উত্তরাধিকারও সেই টাকা বা শেয়ার আর দাবি করেন না।
এর বাইরেও আইনি জটিলতা বা অন্য কারণে লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীর হাতে পৌঁছায় না অনেক সময়। তখন কোম্পানি ওইসব লভ্যাংশ ‘সাসপেন্ডেড’ হিসাবে জমা দেখিয়ে চূড়ান্ত আর্থিক বিবরণী তৈরি করে।
সিডিবিএল হিসাবে থাকা ওই রকম ৩ হাজার ৩১৫টি সাসপেন্ডেড হিসাবে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার অবণ্টিত ও দাবিহীন লভ্যাংশ রয়েছে।
উল্লেখ্য, বিএসইসি ২০২১ সালে এই দাবিহীন লভ্যাংশ এক সঙ্গে এনে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিতরণ এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সিএমএসএফ গঠন করে। ফান্ড ইতিমধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বর্তমান বাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ব্রোকার হাউজগুলোকে স্বল্প সুদে আরও ২৫০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেওয়া হবে এ ফান্ড থেকেই।